মাহমুদ আবদুল্লাহ (হালুয়াঘাট): ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় মানব বসতি এবং ইতিহাস-সংস্কৃতির দিক থেকে প্রায় ৩০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এই এলাকায় ২০০ বছরের পুরোনো বৃক্ষও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অসচেতনতা এবং অতিরিক্ত লালসার করালগ্রাসে এখানকার অনেক ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাচীন বৃক্ষ সম্পদও হারিয়ে গেছে। তাই হালুয়াঘাটের শতবর্ষী বা শতোর্ধ্ববর্ষী বৃক্ষের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি। এমনই একটি শতবর্ষী বৃক্ষ হিসেবে ধারণা করা হয় হালুয়াঘাটের ভুবনকুড়া ইউনিয়নের কুমারগাতী গ্রামের প্রাচীন বটগাছটিকে।
বটগাছের সবুজ পাতায় ছেয়ে আছে চারদিক। ঝুলে পড়েছে এর শাখা-প্রশাখা। গাছে বসে থাকা নানা প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে আশপাশ। গাছটির বয়স সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা নেই। এলাকাবাসীর ধারণা, দুই থেকে আড়াইশো বছর বয়স হবে গাছটির। এই গ্রামের পাকা ফকিরের স্ত্রী ইয়াতুননেছা শতবর্ষী একজন মহিলা ছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি যখন এই গ্রামে বউ হয়ে আসেন, তখন এই গাছটিকে আরো বড় দেখেছিলেন। গাছটির বয়স বাড়ার কারণে এখন গাছের ডালপালা কমে আসছে। প্রাচীন এ বৃক্ষকে নিয়ে এলাকায় অনেক লোকশ্রুতি আছে, অনেকে অলৌকিক গাছ বলে মনে করেন। অপবিত্র শরীরে এ গাছে স্পর্শ করলে তার নানা ধরনের সমস্যা হয় বলে কথিত আছে।
একবার একটি ট্রাক এ গাছের নিচ দিয়ে যাবার সময় ট্রাকটি দেবে যায়। বহু চেষ্টার পরও কোনোভাবেই ট্রাক সরানো যাচ্ছিল না। দু-একদিন এ অবস্থায় থাকার পর বিশেষ মান্নত করার পর ট্রাক আপনাআপনি উঠে আসে। এই গাছের অনতিদূরে বাস করতেন খলিল মিঞা। তার ৬ বছর বয়সী ছেলে শরিফুল একবার গাছের গোড়ায় খেলতে গিয়ে প্রস্রাব করে। এতে তাকে পরী ধরে। কবিরাজি বহু চিকিৎসার পরও তার কোনো সমাধান হয়নি। শেষ পর্যন্ত শরিফুল মারা যায়।
ব্রিটিশ আমলে হিন্দু ধর্মালম্বী হাজংদের বসবাস ছিল অত্র এলাকায়। এ গাছের গোড়ায় তারা পূজা অর্চনা করতেন। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং বাৎসরিক মেলা অনুষ্ঠিত হতো এই গাছকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে এখন আর হাজং বসতি নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এখানে কিছু মানুষ পূজা করতেন বলে জানা যায়।
আজমীর শরীফের খাজা মইনুদ্দিন চিশতি (রহ.)- এর অনুসারী কিছু জ্বীন এখানে বাস করে। আবুল, খুরছুন, হোসেন ইত্যাদি নামে তারা এলাকায় পরিচিত। প্রতিবছর আজমীর শরীফে বাৎসরিক উরসে তারা যোগদান করে। সে সময় এই এলাকার মানুষজনও তাদের মান্নত এবং বিশেষ অনুদান সংগ্রহ করে আজমীর শরীফে পাঠায়। এ গাছের গোড়ায় নানা সময়ে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী ধ্যানে মগ্ন হতেন। এখন সাধু-সন্ন্যাসীদের দেখা না মিললেও অনেকে মান্নত পূরণ করার জন্য আসেন।
এ গাছে প্রচুর পাখি ও বন্যপ্রাণী থাকতো। বন্যপ্রাণীর আনাগোনা আগের মতো না থাকলেও ওয়াব, শিয়াল ও বিপন্ন প্রাণী তক্ষকের দেখা মেলে এখনো। এ গাছের গোড়ায় অনেক খোঁড়ল রয়েছে, এসব খোঁড়লে বাস করে ওয়াব, শিয়ালসহ নানান প্রজাতির সাপ। আশপাশের বাড়ি থেকে ওয়াব-শিয়ালে মুরগি ধরে আনলেও মুরগির কোনো ক্ষতি করে না এই প্রাণীগুলো। এখনে সারা বছরই মৌমাছির চাক থাকে। কিন্তু মধু সংগ্রহ করতে পারে না কেউ। একবার একজন মধু সংগ্রহ করার জন্য গাছে উঠলে জ্বীনে তাকে গাছ থেকে ফেলে দেয়।
এককালে রাত্রি হলেই দেখা মিলতো পেত্নীর। নানান জিনিস নিয়ে তারা ঘোরাফেরা করতো। সেজন্য রাত্রিবেলা এই গাছের পাশ দিয়ে কোনো মানুষ যাতায়াত করত না। আশপাশ এলাকায় ঘনবসতি এবং বিদ্যুতের আলো চলে আসার পর সেই পেত্নীরা উধাও হয়ে যায়। কুমারগাতী গ্রামের আব্দুর রশিদ মিয়া প্রাচীন এ বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ করছেন।
স্থানীয় আলেমদের কাছে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, নিঃসন্দেহে গাছটি প্রাচীন। তবে এই গাছকে উদ্দেশ্য করে মান্নত করা শিরক।
তথ্যসূত্র: উমর ফারুক
পিতা: আব্দুর রশিদ মিয়া
কুমারগাতী, হালুয়াঘাট।
সম্পাদক ও প্রকাশক: ডা. মোহাম্মদ আবু সাঈদ সরকার
ঠিকানা : ৩৭/৬, মসজিদ রোড, বালুরঘাট, ঢোলাদিয়া, ময়মনসিংহ।